অটিজম সচেতনতা ও আধুনিক চিকিৎসা

অটিজম বলতে কী বোঝায়

অটিজম হলো মূলত মানব শরীরে এক ধরণের জটিল বিকাশ প্রক্রিয়া কিংবা প্রতিবন্ধকতা (Complex Developmental Disorder) যা একজন শিশু ছোটকাল থেকেই অস্বাভাবিকতা ধরা পরে এবং এভাবেই বড় হতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন মানুষের শিশু জীবনের প্রথম তিন বছরের মধ্যেই অটিজমের উপস্থিতি বা লক্ষণগুলি ধরা পরে এবং টের পাওয়া যায়। আমরা আজকে অটিজম সচেতনতা ও আধুনিক চিকিৎসা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।

স্নায়ুবৈকল্যের কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজগুলো যখন বাধাগ্রস্ত হতে থাকে, তখন ব্যক্তির অভিব্যক্তি এবং ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অটিজম মস্তিষ্কের বা অন্য কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এক ধরনের বিকাশ প্রতিবন্ধকতা বা Developmental Disorder বলে- যা মস্তিষ্কের নিয়মিত কাজগুলোকে বাধা দেয়। এই কারণে এএসডি আক্রান্ত মানুষের ব্যবহারিক ও দৈনন্দিন জীবন স্বাভাবিকের চাইতে অনেকটাই ব্যতিক্রমী।

তবে বিজ্ঞানের অগ্রগতি, নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে এই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার অনেক মাধ্যম বের হয়েছে। আর এতে উপকৃত হচ্ছে ব্যক্তি নিজে, সমাজ ও রাষ্ট্র। আসলে অটিজম বা স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা প্রচলিত অর্থে কোন ব্যাধি বা রোগ নয়।

এটি একজন ব্যক্তির জন্মগত একটা প্রতিবন্ধকতা। ২ এপ্রিল তারিখটিতে পালিত হয় বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। অটিজম নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি লক্ষ্যে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের বাংলাদেশেরও পালিত হয়।

অটিজম আক্রান্ত শিশু এবং বয়স্কদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তার বিষয়টি তুলে ধরতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালে ২ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে।

এক সময় অটিজম মানেই অবহেলিত জনস্বাস্থ্যের একটি ইস্যু হিসেবে এবং অভিশপ্ত বিবেচনায় দেখা হতো। এই সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক ধারণা থাকলেও বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। অটিজম সচেতনতা ও আধুনিক চিকিৎসা দিয়ে বর্তমানে এসব শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

অটিজম বৈশিষ্ট্য

অটিজম একজন মানুষের মানসিক বিকাশে প্রক্রিয়াগত সমস্যা যা স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও পরিবর্ধন জনিত অস্বাভাবিকতার ফল হিসেবে প্রকাশ পায়। অটিজমে আক্রান্ত শিশু অন্যান্য সুস্থ ও স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে অসুবিধা হয়। অটিজমের কারণে শিশুর কথাবার্তা, চাল-চলন, অঙ্গভঙ্গি এবং আচরণগত ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে তাকে আবদ্ধ করে ফেলে।

আবার অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মানসিক শক্তি এবং কথা শেখা, কথা বলার বা ভাষা ব্যবহারের উপর দক্ষতা কম থাকে। সাধারণত বাচ্চার বয়স যখন ১৮ মাস থেকে ৩ বছর সময়ের মধ্যে অবস্থান করে তখন এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা দিতে থাকে।

তবে দ্রুত কথা না বলা কিংবা কথা বলতে দেরি করা অটিজমের আওতার মধ্যে পড়ে না। তার সাথে তার অন্যান্য আচরণগত বিশিষ্ট্য, সামাজিকতা কিংবা অন্য একটি শিশুর সাথে তার আচরণ অথবা বয়স্ক মানুষের সাথে মিশতে পারার অস্বাভাবিকতা থাকলে সাধারণত একটি শিশুকে অটিজমে আক্রান্ত বলে ধরে নেয়া হয়।

অটিজমে আক্রান্ত শিশু কথা বলতে পারে কিছুটা অস্বাভাবকি ভাবে, আবার একদম নাও বলতে পারে। আবার কথা বললেও হয়তো পুরোপুরি গুছিয়ে বলতে পারে না কিংবা আংশিক পারে। আবার একজন সুস্থ মানুষ যেভাবে কথা বলতে পারে সেভাবে আক্রান্ত শিশু কথা নাও বলতে পারে।

অটিজম কেন হয়?

অটিজম হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বা ব্যাখ্যা নেই। পরিবেশগত কিংবা বংশগত কারণেও একজন শিশু এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত জটিলতার ধরণ, লক্ষণ, বাচ্চার গঠনপ্রক্রিয়া এবং রোগের তীব্রতার উপর নির্ভর করে এই সমস্যাগুলির কারণ বিভিন্ন হতে পারে।

চিকিৎসকরা মনে করেন, ভাইরাল কোন ইনফেকশন, মায়ের গর্ভকালীন জটিলতা এবং বায়ু দূষণকারী উপাদানসমূহ স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় সক্রিয় ভূমিকা রাখে। আবার কোন কোন শিশুর ক্ষেত্রে জেনেটিক ডিজঅর্ডার কার্যকর থাকতে পারে। যেমন- রেট সিন্ড্রোম বা ফ্র্যাজাইল এক্স সিন্ড্রোমের সাথে এই রোগটি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

এমন কিছু জীন আছে যারা মস্তিষ্কের কোষসমূহের পরিবহন ব্যবস্থায় বাধা প্রদান করে এবং রোগের তীব্রতা বৃদ্ধিতে কার্যকর সহায়তা করে। জেনেটিক বা জীনগত সমস্যা হতে পারে আবার বংশগতও হতে পারে। আবার নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই এই রোগটি হয় বলেও গবেষণায় পাওয়া গেছে। তবে ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধকের সাথে অটিজমের কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অটিজম শিশুদের বর্তমান পরিস্থিতি

অটিজম বা অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার একজন শিশুর স্নায়ুবিক-বিকাশজনিত সমস্যা (নিউরোডোপোভমেন্টাল ডিসঅর্ডার)। এটি আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের তৈরি করা মানসিক রোগের শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিতে রচিত হয়েছিলো। অটিজম উন্নত বিশ্বের মতোই আমাদের বাংলাদেশেরও একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।

সারা বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশেও আজকাল অটিজম আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯০ সালের জরিপ অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী অটিজমের সংখ্যা ছিলো প্রতি দশ হাজারের মধ্যে মাত্র একজন। ২০০৯ সালের জরিপ অনুযায়ী পাওয়া যায় প্রতি দশ হাজার শিশুর মধ্যে অটিজম শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫০ জন।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়, গ্রামগুলির তুলনায় শহরে অটিস্টিক শিশু জন্মের হার বেশি। এই গবেষণা অনুযায়ী, গ্রামে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ১৪ জন শিশু অটিজমে আক্রান্ত হয় কিন্তু শহর এলাকায় প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে অন্তত ২৫ জন শিশুই অটিজম বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকে।

গবেষণায় আরও দেখা যায় মেয়ে শিশুর চাইতে ছেলে শিশুর মধ্যে অটিজমে আক্রান্তের হার প্রায় আড়াই গুণ বেশি। তাছাড়া দেশে ১৬ মাস থেকে ৩০ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে অটিজম বিস্তারের হার প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে প্রায় ১৭ জন। তবে বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখের মতো অটিজম আক্রান্ত মানুষ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন,  অটিজম কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি মূলত মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের প্রতিবন্ধক একটি মানসিক সমস্যা। এটি একজন মানুষের হরমোন জনিত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ। অটিজমের প্রতীকী রং হলো নীল। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে পরম মমত্ববোধ এবং অটিজম সচেতনতা ও আধুনিক চিকিৎসা এর মাধ্যমে একজন শিশুর সমস্যা অধিকাংশেই কমিনে আনা সম্ভব হয়।

অটিজমের সাধারণ লক্ষণ

অটিজমের লক্ষণগুলো সঠিকভাবে যদি কারো জানা থাকে তাহলে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা সহজ হবে। অটিস্টিক শিশুদের সাধারণত ঘুমের সমস্যা হতে পারে। ঘুম স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে তাদের মনোযোগ ও কাজের সক্ষমতা কমে যায়। তাদের অস্বাভাবিক আচরণে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। অনেক শিশুর ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে কথা বলতে সমস্যা হতে দেখা যায়।

মুলত ১৮ মাস থেকে ২ বছর সময়ের এই সমস্যাগুলি বুঝতে পারা যায়। অনেক অটিস্টিক শিশুর মধ্যে সামান্য পরিমাণ হলেও বুদ্ধির প্রতিবন্ধকতা দেখা যায়। অনেক শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে বাড়ে না। অটিজমে আক্রান্ত অনেক শিশুর দেখা ক্ষেত্রে, শোনা, গন্ধ, স্বাদ গ্রহণের ক্ষেত্রে অথবা স্পর্শের প্রতি খুব বেশি সংবেদনশীল কিংবা প্রতিক্রিয়াহীন হতে পারে।

সাধারণত অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে প্রতি চারজনে একজন শিশুর মধ্যে খিঁচুনি সমস্যা থাকতে পারে। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের মানসিক অস্থিরতার ঝুঁকি বেশী থাকে এবং এই সকল শিশুদের বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা ও মনোযোগের ঘাটতিসহ বিভিন্ন ধরণের আচরণগত এবং মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে প্রায়ই খাওয়া-দাওয়ার অনিহা ও হজমের অসুবিধা হতে পারে। পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটে গ্যাস জমা হওয়া এবং বমি হওয়া ইত্যাদি ধরণের সমস্যা হতে পারে। অটিজম সচেতনতা ও আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ এসব সমস্যা অনেক ক্ষেত্রে কমিয়ে আনা সম্ভব।

অটিজমের প্রধান লক্ষণ

* ছয় মাস বয়স বা তার বেশি বয়সে হাসতে পারা, হাত-পা ছুড়ে খেলা করা অথবা যে কোন আবেগ প্রকাশ করতে না পারা।
* ১২ মাস বয়সের মধ্যে আধো আধো কথা বলতে না পারা অথবা ইশারায় বা হাত বাড়িয়ে কিছু চাইতে বা ধরতে না পারা।
* চোখে চোখ রেখে তাকাতে না পারা।
* বেশি লোকজন থাকলে অস্বস্থির অনুভূতি প্রকাশ করা বা ভীড় এড়িয়ে একা থাকতে পছন্দ করা।
* অন্যের অনুভূতি বুঝতে না পারা।
* একই নিয়মে ও একই ভাবে চলতে পছন্দ করা। নিয়মের সামান্য ব্যতিক্রম হলেই বিরক্তি প্রকাশ বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানো।
* একই শব্দ বারবার বলতে থাকা বা একই আচরণ বারবার করতে থাকা। কিংবা একই ভাবে হাত বা মাথা বার বার নাড়াতে থাকা।
* বিশেষ কোন রং, একই শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ বা স্বাদের প্রতি কম অথবা বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল হওয়া।
* কোন বিষয়বস্তুর প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহ দেখানো।

অটিজম চিকিৎসা

উল্লেখিত লক্ষণগুলো কোন বাচ্চার ক্ষেত্রে দেখা দিলে অথবা কোনও শিশু অটিজমে আক্রান্ত মনে হলে অনতিবিলম্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া অত্যন্ত জরুরী। প্রাথমিক অবস্থায় অটিজমের লক্ষণগুলো ধরা পড়লে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করলে অটিজম এর ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়াগুলোকে মোকাবেলা করা সম্ভব।

এই ধরনের শিশুদের জন্য প্রচুর বিশেষায়িত স্কুল রয়েছে। আর এসব স্কুলে আক্রান্ত শিশুদের বিশেষভাবে পাঠদান করা হয়। এ ধরনের স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে সাধারণত একজন অকুপেশনাল থেরাপিষ্টের পরামর্শ নিয়ে ভর্তি দিতে হয়। তিনি রোগী দেখে পরামর্শ দেবেন, কোন ধরনের স্কুল শিশুর জন্য উপযুক্ত হবে।

তাছাড়া অনেক অটিস্টিক শিশুর কিছু মানসিক সমস্যা থাকতে পারে, যেমন- চঞ্চলতা, অতিরিক্ত ভীতি, ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের ঘাটতি ইত্যাদি। এই ধরণের সমস্যার ক্ষেত্রে চিকিৎসক মনে করলে কোন ঔষধ প্রয়োগ করতে পারেন।

অটিজম এর আধুনিক চিকিৎসা

আমরা জানি অটিজম একটি নিউরোডেভেলপমেন্টাল পরিস্থিতি যা পারস্পরিক সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং যোগাযোগের সীমাবদ্ধ, পুনরাবৃত্তিমূলক আগ্রহের জায়গা, আচরণগত বা কার্যকলাপের পার্থক্য দ্বারা চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। অটিজমের চিকিত্সা সাধারণত স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (ASDs) নির্ণয় করে এবং আক্রান্তের পরিবারগুলিকেও প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা দেওয়া মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হয়।

কিন্তু আধুনিক কালে সারা পৃথিবীতে স্টেম সেল থেরাপির মাধ্যমে অটিজমের খুবই ভালো চিকিৎসা দেয়া শুরু হয়েছে। চিকিৎসকরা দাবী করেন, এই স্টেম সেল থেরাপীর মাধ্যমে একজন অটিজম শিশুকে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, খাওয়া-দাওয়া, নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারা এবং একটি জটিল পরিস্থিতি থেকে খুব সহজেই বের করে আনা সম্ভব হচ্ছে।

বর্তমানে আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্টেম সেল থেরাপি চিকিৎসার মাধ্য হাজার হাজার অটিজম শিশুকে সারিয়ে তোলা হচ্ছে। আমাদের দেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সীমিত পরিসরে পিজি হাসপাতালে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

অটিজম শিশুদের ক্ষেত্রে করণীয়

পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এটি মোকাবেলা করা সম্ভব। একটি পরিবারে কারো অটিজম সমস্যা থাকলে অথবা কোন মানসিক এবং আচরণগত সমস্যা থাকলে, পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে অটিজমের ঝুঁকি অনেকটা বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে পরিকল্পিত গর্ভধারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত।

গর্ভাবস্থায় দুশ্চিন্তা না করা, পর্যাপ্ত ঘুমানো, শিশুর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া বেশি বয়সে বাচ্চা না নেওয়া বা বাচ্চা নেয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে কাজ করা বা মাকে প্রয়োজনীয় ভেকসিন বা চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া। গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন রকম ঔষধ না খাওয়া।

তাছাড়া মায়েদের ধূমপান করা, মদ্যপানের মত কোন অভ্যাস বা মাদকাসক্ত থাকলে বাচ্চা নেয়ার আগে অবশ্যই তা ছেড়ে দিয়ে বাচ্চা নিয়া জরুরী। সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষেত্রে মায়েদের যেমন ভূমিকা আছে তেমনি বাবাদেও ভূমিকা রয়েছে। একজন পিতা যদি নান ধরণের উত্তেজক দ্রব্য, মাদকদ্রব্য, মদ্যপান, মাদকাসক্ত অবস্থায় থাকেন, তাহলে এর প্রভাব বাচ্চার ওপর পড়তে পারে। তাই এগুলি এড়িয়ে গিয়ে বাচ্চা নেয়া ঠিক হবে।

অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য যেমন আলাদা; আবার তাদের প্রতিভাও ভিন্ন ভিন্ন। যেমন কেউ ভালো ছবি আঁকতে পারে আবার কেউ একটি কাজকে গুছিয়ে সুন্দর করে করতে পারে। আবার কেউ হয়তো হাতের কাজ ভালো করে করতে পারে, আবার কেউ সেলাইয়ের কাজ ভালো জানে। আর এসব কাজকেই অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে উৎসাহিত করার জন্য সাফল্য হিসেবে দেখতে হবে।

এছাড়াও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর জন্য কেবল মাকে নয়, বাবাসহ পরিবারের সবার সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। জিমনেসিয়াম, সুইমিং পুলসহ অটিজম শিশুদের জন্য উপযোগী খেলাধুলায় সপ্তাহে অন্তত একদিন তাদের বিশেষ সুযোগ দেয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

কিছু বিষয়কে অটিজম শিশুরা খুবই পছন্দ করে থাকে। আবার কিছু বিষয়কে তারা প্রচণ্ড ভয় পায় কিংবা সহ্য করতে পারে না। এসব শিশুর বয়স বাড়লেও সেই তুলনায় তাদের বিচার-বুদ্ধির উন্নতি তুলনামূলক খুবই কম হয়। ডাক্তারী ভাষায় এসব শিশুকে বলা হয় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু অথবা কোন একটি বিষয়ে অত্যধিক ঝোঁক সম্পন্ন শিশু। সাধারণভাবে এসব শিশুদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।

বিশেষ শিশুদের ভালো রাখার প্রয়োজনে অভিভাবক বা পরিবারের লোকদেরও কাউন্সিলিং দরকার। কারণ এই শিশুদের অভিভাবকরা ভালো থাকলে তাদের সন্তানটিকে ভালো রাখতে পারবেন। আর অটিজম শিশুদের জন্য এমন একটি মানসিক সমস্যা যাতে তারা কথা বলা, কাজ-কর্ম করা কিংবা খেলাধুলা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করতে পারেনা।

সামাজিকতা ও আচরণগত বিকাশ

অটিষ্টিক শিশুদের প্রয়োজনীয় সামাজিক আচরণ খুব যত্ন সহকারে শেখানো জরুরী। এক্ষেত্রে যা করা যেতে পারে-

* সমবয়সী স্বাভাবিক শিশুদের সাথে মিশতে ও ভাবের আদান-প্রদান করার ক্ষেত্রে আন্তরিক সহযোগিতা করা।
* কখনই একাকী খেলতে না দেয়া। অন্য কারো সাথে খেলতে দেয়া এবং একে অন্যের কাছ থেকে যেন সহানুভূতিশীল আচরণ এবং ভাব আদান প্রদান করা শিখতে পারে।
* সম্ভাষণ করতে শেখানো। হাসির জবাবে হাসি দিয়ে উত্তর দেয়া, আনন্দ প্রকাশ করা, করমর্দন বা সালাম বিনিময় করতে শেখানো, বিদায় সুচক অঙ্গভঙ্গি বা হাত নাড়ানো, শরীরিক স্পর্শদ্বারা বন্ধুত্ব প্রকাশ করতে পারা ইত্যাদি।
* আদান-প্রদানমূলক খেলা যেমন- বল দেয়া-নেয়া হতে পারে, গাড়ি বা কোন খেলনা দেয়া-নেয়া ইত্যাদি।
* নিয়ম করে শিশুদের সাথে বিভিন্ন ধরণের সহজ খেলা, যেমন লুকোচুরি খেলা, আঁকাঝুকি করা, কোন অক্ষর বা সংখ্যা দিয়ে শিক্ষামূলক ও গঠনমূলক খেলা ইত্যাদি।
* শিশুকে খেলার মাঠে-পার্কে বা কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া এবং তার মতো করে সহজভাবে চলাফেরা করতে দেয়া।
* তত্ত্বাবধানের সাথে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কিংবা অন্যান্যদের সাথে খেলায় সক্রিয় অংশগ্রহনের জন্য উৎসাহিত করা।
* শিশুটিকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নিয়ে যাওয়া। এটা ধরো না, ওটা করো না, সারাক্ষণ এই জাতীয় নেতিবাচক শব্দ পরিহার করা।
* কেউ যেন শিশুটিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে সেদিকে ভালো করে খেয়াল রাখা এবং বুঝিয়ে বলা।
* বিরূপ সমালোচনা না করা এবং কোন কঠিন আচরণের দিকে যাতে না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।

অটিজম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা

* অটিজম একটি আচরণগত, আবেগজনিত ও মানসিক স্বাস্থ্যঘটিত ডিজঅর্ডার। এটি শারীরিক কোন সমস্যা নয়।
* অটিজমের সঙ্গে বিকাশগত অক্ষমতা ও নিউরো-বায়োলজিক্যাল ডিজঅর্ডার জড়িত। জন্মের তিন বছরের মধ্যেই সাধারণত এর লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং আজীবন এই অক্ষমতার সমস্যায় ভোগতে থাকে।
* শিশু বয়সে নেয়া টিকা অটিজমের জন্য কোন ভাবেই দায়ী নয়। অনেকের ধারনা মাম্পস-মিসেলস-রুবেলা (গগজ) ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধকের ব্যবহারের কারণে অটিজম হয়ে থাকে। এটি একেবারেই ভুল ধারণা। এ নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, কিন্তু কোন সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ভ্যাকসিন সব বাচ্চারাই নিয়ে থাকে। সমস্যা হলে যারা ভ্যাকসিন নেয়, তাদের সবারই একই সমস্যা হওয়ার কথা ছিলো।
* পিতামাতার দুর্বল অভিভাবকত্ব সন্তানের অটিজমের জন্য দায়ী, সমাজে এমন কথা প্রচলিত থাকলেও এটি একেবারেই ভিত্তিহীন কথা। কাজেই অটিজম বাচ্চার জন্য কোন বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজন নিজেদের দোষী ভেবে কষ্ট পাওয়া অথবা বাবা-মাকে দায়ী করে করে কারো কথা বলার যৌক্তিকতা নেই।
* অটিস্টিকদের সবার সমস্যাই একরকম নয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের লক্ষণ ও উপসর্গের মাত্রা অনুযায়ী সমস্যাও বিচিত্র রকমের হতে পারে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের হুবহু মিল নাও থাকতে পারে। এটির জন্য কোন ভাবেই পরিবার বা বাবা-মাকে দায়ী করা বোকামী ছাড়া কিছুই নয়।
* অনেকে বলে থাকেন, এটা একটা সাময়িক সমস্যা; বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেরে যাবে। বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কোন দরকার নেই। এই জাতীয় কথায় কান না দেয়া। কারণ অটিস্টিক শিশু কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠবে না। তাই তাকে শুরু থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা উচিত।
* অটিজম নিরাময়যোগ্য রোগ। চিকিৎসা করালে অটিস্টিক ব্যক্তি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তাই যে যেখানে বলে সেখানেই ছুটে চলা। কিংবা মানুষের কথা শুনে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বা ঝাড়-ফুকের মধ্যেমে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা বোকামি কাজ হবে। এসব বাচ্চাকে অটিজম সচেতনতা ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ও আচরণগত পরিবর্তনের জন্য সহযোগিতা করা উচিত হবে।
* অনেকে মনে করেন, অটিজম থাকলে বাচ্চার অন্য কোন ধরণের ডিজঅর্ডার থাকেনা। এই ধরণের কথা একেবারেই অবান্তর। অটিস্টিক শিশুদের ক্ষেত্রে ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি, অন্ধত্ব, বধিরতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার ঘটনা অস্বাভাবিক তো নয়ই; বরং একেবারেই সাধারণ। মূলত এসব অটিজম সচেতনতা ও আধুনিক চিকিৎসা এসব শিশুদের বিজ্ঞানসম্মত জীবন দিতে পারে কোন কুসংস্কার নয়।

পরিশেষে বলা যায় আমাদের প্রত্যেকের অটিজম সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় মায়েদের প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হওয়া জরুরী। সেইসাথে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তরে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভক্তি রাখা উচিত।

কারণ একটি শিশুকে স্বাভাবিক ভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হলে, তাকে দেশের সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। কারণ একজন মানুষের এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, আর সেই অধিকারে আমাদের সবারই সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত।

 

আরও পড়ুন : ডেঙ্গু জ্বরের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

Leave a Comment