গণঅভ্যুত্থান ২০২৪, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন মোড়

গণঅভ্যুত্থান ২০২৪, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন মোড়
গণঅভ্যুত্থান ২০২৪

বিগত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসেছিলো এক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার সম্মিলিত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসক হাসিনা গদি ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা দীর্ঘ সময়ের এক দলীয় মাফিয়া শাসনের অবসান ঘটায়। এটিকে বাংলাদেশের জন্য কেউ কেউ দ্বিতীয় স্বাধীনতা বা গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ হিসেবে অভিহিত করে থাকে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে জনমানুষের মধ্যে এক স্বস্থি ফিরে আসে এবং ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকারের শাসনের মাধ্যেমে বাংলাদেশ নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দূরত্ব

১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক মোটামুটি সব সময়ই সংবেদনশীল অবস্থানে ছিলো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিবেচনায় যথেষ্ট আলোচনা হলেও অধিকাংশ সময়ই এটি নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামিলীগের আমলে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবনতি ঘটে এবং এটি নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরণের রাজনৈতিক গেম খেলা হয়।

অথচ বর্তমান দুনিয়ায় প্রতিবেশীসহ সারা পৃথিবীতে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং নিজ নিজ রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই আন্তদেশীয় যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হয়। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ১৯৭১ সালে যুদ্ধের কারণে যতটা না খারাপ তার চেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে পাকিস্তানকে ব্যবহার করে ফায়দা তোলার চেষ্টার কারণে। গণঅভ্যুত্থান ২০২৪, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন মোড় নিচ্ছে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ

সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নানা পরিবর্তনের মতো পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। দুই দেশের নেতাদের কথাবার্তা থেকে আভাস পাওয়া যায় নতুন বাংলাদেশের সাথে তাদের সম্পর্কের নতুন রসায়নের।

বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের কূটনীতিতে সম্পর্ক পুনস্থাপন এবং সম্প্রসারণের পরিবর্তনের আভাস লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বলা যায় পাকিস্তানের তরফ থেকে বাংলাদেশের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে এবং বাংলাদেশও দুই দেশের নিজ নিজ স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার জন্য ইতিবাচক সারা দিচ্ছে।

সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা

বিপ্লব পরবর্তী সময়ে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের পর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অনেক দেশে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানিয়েছে এবং সেই সাথে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে এবং বেশ কয়েকবার সরকার প্রধানের সাথে সাক্ষাতৎও করেছেন। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৃহত্তর দল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তারা নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। ইতোমধ্যে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশীদের সেই দেশে ভ্রমণ করার জন্য ভিসা ফি বাদ ভিসা প্রক্রিয়া সহজতর করেছে এবং সরাসরি ফ্লাইট চালু করার যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছে।

গণঅভ্যুত্থান ২০২৪, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন মোড়
গণঅভ্যুত্থান ২০২৪, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন মোড়3.jpg
কূটনৈতিক তৎপরতা

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বাংলাদেশের সাথে নতুন করে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশে কাজ করে যাওয়া সাবেক কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক করেছেন এবং সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য নতুন কৌশলগত রোডম্যাপ তৈরি করেছেন । অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে আলোচনায় দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে আরও জোড়দার করার আগ্রহ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে নিজেই পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন শাহবাজ শরিফ।

তাছাড়া সম্প্রতি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুমতাজ যেহরা বালোচ জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে পাকিস্তান বরাবরই শ্রদ্ধাশীল। পাকিস্তান সব সময়ই বাংলাদেশের বিষয়ে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক অবস্থানের বিষয়ে আগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আগ্রহ

বাংলাদেশের বিপ্লবকে পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকেরা ব্যাপক সমর্থন দিয়েছে এবং এর প্রতিফলন সেই দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। তাছাড়া বিভিন্ন মিডিয়াতেও বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানকে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।

পাকিস্তান হাইকমিশনের ফেসবুক পাতাজুড়ে বাংলাদেশের বর্তমান হাল-হকিকত এবং সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পোস্ট লক্ষ করা যায়। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে শুভেচ্ছা ও সৌহার্দ্যের আহ্বান- এমন নানা পোস্টও চোখে পড়ে।

বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব

বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহলের ধারণা বিগত বছরগুলিতে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল যাচ্ছিল এবং সাম্প্রতিক পাকিস্তানের নানা তৎপরতা থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে পাকিস্তান সেই শীতল সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে এসে দুই দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে অত্যন্ত আগ্রহী।

তাছাড়া গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের সরকার ভারতের চোখ দিয়ে পাকিস্তানকে দেখেছে এবং ভারতের চির শত্রু পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নকে ভালো চোখে দেখেনি বলে ১৯৭১ সালকে ঘিরে বিভাজনের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে, যেটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন।

হাসিনা সরকারের আমলে ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে অনেক পুরানো একটা অত্যন্ত সৌহার্দ এবং সম্প্রীতির জায়গা ছিল যা শুধুমাত্র ভারতের সাথে বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে সেটিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। একইসাথে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের পেছনে ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমগুলিতে ঘৃণার সংস্কৃতি প্রচারের কারণেও বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক অবনতিকে দায়ী করা হয়।

ভারতের প্রতিক্রিয়া

শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের নতুন মাত্রাকে ঘিরে ভারতের মূলধারার মিডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে উদ্বেগ উঠে আসতে দেখা যায়। ভারতীয় গণমাধ্যমে অনেকটা বিষোদগারের মতো করে প্রোপাগাণ্ডা ছড়াতে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ কি পরবর্তীতে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে পরিণত হবে? মূল কথা হলো বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের নতুন মেরুকরণকে ভারত ভালো চোখে দেখছে না।

১৯৭১ সালের যুদ্ধে ক্ষমার প্রসঙ্গ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকদিন ধরেই একটি কমন আলোচিত বিষয় ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া বা স্বীকৃতি প্রসঙ্গ। তবে এই নিয়ে নিয়ে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একাধিকবার কথা বলেছেন, কিন্তু পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি এখনো করেনি।

গণঅভ্যুত্থান ২০২৪, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন মোড়
গণঅভ্যুত্থান ২০২৪, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন মোড়3.jpg

তবে এই বিষয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বালোচ মনে করেন, ১৯৭১ সালের বেদনাদায়ক ইতিহাস বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান দুই দেশই বহন করে চলেছে। কিন্তু সে সমস্যার একটি সঠিক ও উপযুক্ত সমাধান ১৯৭৪ সালেই দুই দেশের নেতারা করেছেন এবং চুক্তিও হয়েছে বলে মি. বালোচ উল্লেখ করেন।

১৯৭১ সাল নিয়ে দুই দেশের অস্বস্থি

১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যকার ত্রি-পক্ষীয় চুক্তির বিবরণে দেখা যায় যে, জুলফিকার আলি ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন, যেন তারা পাকিস্তানকে ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের তিক্ততা ভুলে গিয়ে নতুন করে সম্পর্ক উন্নয়ন করে সামনের দিকে এগিয়ে যান।

সে সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকেও অতীত ভুলের কারণে সম্পর্কের অবনতি না করা এবং ক্ষমার নিদর্শন হিসেবে বিচার না চালানোর সিদ্ধান্তের কথার উল্লেখ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের একটি আর্কাইভ প্রতিবেদনে।

বাণিজ্যিক সুবিধা

বাংলাদেশের এবং পাকিস্তান সীমান্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্র না হলেও বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাণিজ্যিক সম্পর্ক একটা বড় দিক রয়েছে উভয় দেশের মধ্যে। আগেই উল্লেখ করেছি, আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক শীতল থাকলেও বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের বাণিজ্যিক সম্পর্কটি বন্ধ ছিল না।

বাংলাদেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, টেক্সটাইল খাত এবং গার্মেন্টস খাতে পাকিস্তানিদের বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে পাকিস্তান বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে।

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত এবং শিল্প খাতের জন্য আমদানি তালিকায় রয়েছে তুলা, কাপড়, বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্য, খনিজ ও বিভিন্ন ধাতব উপাদান, বৈদ্যুতিক সামগ্রী এবং মেশিনারীজের কাঁচামালসহ নানাবিধ পণ্য। বাংলাদেশ থেকে পাট এবং পাটজাত পণ্য, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, সিনথেটিক ফাইবার, টেক্সটাইল বিবিধ সামগ্রী, চিকিৎসায় ব্যবহৃত সামগ্রী রফতানি হয় পাকিস্তানে।

একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রফতানি হয়েছে ছয় কোটি ৩৩ লাখ ডলারের বেশি পণ্য এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ৬৫ কোটি ৫ লাখ ডলারের চাইতে বেশি পণ্য। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৮৩ কোটি ডলারের চাইতেও বেশি টাকার পণ্য আমদানি করেছে পাকিস্তান থেকে। কাজেই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হলে হয়তো বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ আরও বৃদ্ধি পাবে।

গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খা

বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সাথে উভয় দেশের নিজ নিজ স্বার্থের কারণেই সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন। দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছাড়াও বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং পুরাকীর্তি ও দর্শনীয় স্থানগুলিকে টার্গেট করে উভয় দেশে নিজ নিজ পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে পারে। কাজেই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ইতিবাচক ভাবে কাজে লাগাতে পালে হয়তো উভয় দেশ লাভবান হবে।

তাছাড়া যাতায়াত সহজতর হলে উভয় দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিনিময় হতে পারে এবং চিকিৎসাসহ ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনার জন্য উভয় দেশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অগ্রাধিকার দিতে পারে। বর্তমান যুগে একটি রাষ্ট্রকে উপেক্ষা করে আরেকটি রাষ্ট্র চলতে পারে না। উভয় দেশের সম্মানকে বজায় রেখে সম্পর্ক উন্নয়নকে উভয় দেশের সাধারণ নাগরিকেরা ইতিবাচক ভাবেই দেখতে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *