বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিমের তালিকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস

বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিমের তালিকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর নাম উঠে এসেছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম উঠে আসা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য এক বিরল গৌরব। সম্প্রতি জর্ডানের অভিজাত রয়েল ইসলামিক স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ সেন্টার কর্তৃক মুসলিম নেতাদের তালিকা সংবলিত ৩২১ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই তালিকার নাম দেওয়া হয়েছে ‘পারসন্স অব দ্য ইয়ার: দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ৫০০ ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মুসলিমস’। এই তালিকাতেই ড. ইউনূসের ব্যাপক প্রশংসা করে তালিকাভূক্ত করা হয়েছে।

গত ১৬ বছর থেকে প্রতিবছর প্রকাশিত এই তালিকায় পাঁচটি ক্যাটাগরিতে প্রভাবশালী মুসলিমদের নির্বাচন করা হয়ে থাকে। ক্যাটাগরিগুলো হলো- ধর্মীয়, রাজনৈতিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিল্প এবং সংস্কৃতি এবং ক্রীড়া ও বিনোদন ক্যাটাগরি। এই ক্যাটাগরিগুলিতে সেসব মুসলিম ব্যক্তিত্বকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে যারা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে থাকেন।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মাইক্রোফাইন্যান্স এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিশ্বজুড়ে তার পরিচিতি রয়েছে। বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিমের তালিকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়াও এই তালিকায় আরও অনেক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব স্থান পেয়েছেন। তাদের মধ্যে জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ ইবন আল-হুসেইন, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি এবং ইরানের আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিসহ সারা পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় মুসলিম ব্যক্তিত্বরা স্থান পেয়েছেন।

দারিদ্র্য দূরীকরণের ইউনিক উদ্যোগে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরল অর্জন এবং যে প্রতিশ্রুতি রয়েছ, তার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী গভীর শ্রদ্ধা পেয়েছেন। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের এই উত্তাল সময়ে তিনি দেশকে পরিচালনার জন্য একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতাসহ আপামর জনসাধারণ মাধ্যমে বিবেচিত হয়েছেন।

গত ১৬ বছর শেখ হাসিনার চরম ফ্যাসিষ্ট শাসনামল এবং কর্তৃত্ববাদী বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দেশকে প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। দেশকে একটি মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করা প্রায় জাহেলিয়াতি দেশে ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণবিস্ফোরণে টিকতে না পেরে ভারতে পালিয়ে যায়। এর তিন দিনের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

শেখ হাসিনার উত্তেজনাকর উন্মাদের মতো বক্তব্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়স্বজনের উছিলায় নিজের দলীয় ও আত্মীয় স্বজনকে উচ্চ পদে চাকরি দেয়াকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলন শুরু হলেও সে সময় ব্যাপক দমন পীড়নের কারণে বেশি দূর এগোতে পারেনি। একই ইস্যুতে ২৪ সালে আদালতের একটি ফরমায়েশি রায়কে কেন্দ্র করে আবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশব্যাপী বিম্ববিদ্যালয়গুলিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে।

মূলত বিগত ১৬ বছর দুর্নীতি ও কর্তৃত্ববাদী শাসন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া ইত্যাদি কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুণ জ্বলতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় কোটা আন্দোলন এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধি আন্দোলনে রূপ নেয় এবং সারা দেশে এর আগুণ ছড়িয়ে পড়ে।

জুলাই গণহত্যার কারণে দেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আগ্নেয়গিরির দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করার এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। এ সময় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশের ছোট বড়, ছাত্র, যুবক থেকে শুরু করে সাধারণ শ্রমিক ও রিক্সাওয়ালা পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসেন। হতাশাগ্রস্ত মানুষ একমাত্র মুক্তির উপায় মনে করে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন।

কর্তৃত্ববাদী, দুর্নীতিপরায়ণ এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন এবং নজীরবিহীন বিক্ষোভ দেখান।হাসিনার অনুসারী এবং পারিবারিকভাবে নিয়োগ পাওয়া নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা জনগণের ওপর নিষ্ঠুরভাবে শক্তি প্রয়োগ করে এবং রাজপথে বিপুল সংখ্যক মানুকে হত্যা করে।

মানুষ আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং অপশেষে ৫ই আগস্ট ২০২৪ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর মধ্যদিয়ে হাসিনার দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্র জনতার অনুরোধে সরকার প্রধান হতে সম্মতি দেন।

রাজনৈতিক ব্যাপক অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দূর্নীতি, লুটপাট, ব্যাংক ডাকাতি, আইনের শাসনের কবর রচনাসহ দারিদ্র্যতা এবং ঋণনির্ভর অর্থনীতির একটি বিশৃঙ্খল সময়ে এসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেশের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। তার এই দায়িত্ব গ্রহণের ফলে দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে আশার আলো জেগেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের কিছু বিষয়ে অগ্রগতি থাকলেও বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত। দেশটি অব্যাহতভাবে গভীর কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানী খাত গার্মেন্টস শিল্প হলেও বিগত বছরগুলিতে নান বিশৃঙ্খলার কারণে এই শিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক যার অধিকাংশেই নারী। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের শতকরা ৮২ ভাগ এই খাতের নিয়ন্ত্রণে।

বছরের পর বছর ধরে শ্রমিকদের অমানবিক পরিস্থিতিতে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের কারণে কমপক্ষে এক হাজার শ্রমিক নিহত হন এবং কমপক্ষে ২৫০০ শ্রমিক আহত হয়েছিলেন। এই ঘটনার পর এই খাতে অনিয়মের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের চোখে পড়ে। এই ঘটনার পর গার্মেন্টস শিল্পে বেশ কিছু সংস্কার আনা হলেও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি নিরাপত্ত দেয়া সম্ভব হয়নি।

তাছাড়া শ্রমিকদের বরাবরই বেতন এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য প্রায়ই আন্দোলনে যেতে দেখা যায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার শপথ নেয়ার পর এই শিল্পে ব্যপক অস্থিরতা দেখা দেয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি এবং গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনার পর পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে এবং সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের বেশ কিছু দাবী দাওয়া পূরণের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

দেশকে স্থিতিশীলতায় আনা, দেশের ভেঙ্গে যাওয়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তোলা, রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো, অবাধ এবং সুষ্ঠু ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার এক দুর্দান্ত কাজ হাতে নিয়েছেন ড. ইউনূস।

তার হাত ধরেই জনগণ একটি পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে রয়েছে এবং ছাত্ররা সংস্কার দাবির কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছেন। ২০২৪ সালটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে স্মরণীয় ইতিহাস হয়ে থাকে। অনেকে এটিকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকেন।

এসব কিছু বিবেচনা করে এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভূয়সী প্রশংসা করে পারসন্স অব দ্য ইয়ার: দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ৫০০ ইনফ্লুয়েন্সিয়াল মুসলিমসে আর্টিক্যাল ছাপা হয়। সেখানে স্থান পাওয়া বিশ্বের ৫০০ প্রভাবশালী মুসলিম নেতার মধ্যে ড. ইউনূসের অবস্থান ৪৫০ তম। আবার পুরো তালিকা থেকে সর্ব শীর্ষ ৫০ জনকে পুনরায় বাছাই করা হয়।

পরবর্তী বাছাই পর্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অবস্থান ৫০তম উঠে আসে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই অবস্থান নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। নোবের বিজয় ছাড়াও বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সৃজনসীর কাজ এবং মোটিভেশনাল কর্মের জন্য আগে থেকেই তিনি সমাদৃত।

তাছাড়া সম্প্রতি তার থ্রি জিরো ক্লাবের আইডিয়ার জন্য সারা দুনিয়ায় হৈচৈ পড়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং ব্যবহার করে বাংলাদেশকে একটি সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারবেন। তাই বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিমের তালিকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস উঠে আসাতে দেশের ইতিবাচক পরির্বতনের আশায় দেশবাসীর আকাঙ্খা বেড়ে গেছে।

আরও পড়ুন : সমন্বয়ক মাহফুজ আলম : এক সংক্ষিপ্ত পরিচয়

Leave a Comment